ইতিহাসের রহস্যময় ধনজাহাজ: চীনের মিং সাম্রাজ্যের ভাসমান সাম্রাজ্য

 



www.postnest.me


ভূমিকা

1300 সালের শেষের দিকে তৈরি এক পর্তুগিজ জাহাজ এবং চীনের মিং সাম্রাজ্যের ধনজাহাজ বিশ্বকে তাক লাগিয়েছিল। সমুদ্রের বুকে ভাসমান এই দানবীয় জাহাজ যেন এক আস্ত ভাসমান নগরী। চারতলা ডেক, শত শত কামান, হাজার হাজার সৈন্য আর ঘোড়ায় ভর্তি বহর—ইতিহাসে এমন জাহাজের অস্তিত্ব নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে।


এক দৈত্যাকার নৌবহরের জন্ম

চীনের মিং সাম্রাজ্যে এমন জাহাজ একটার বেশি ছিল না, বরং শত শত ছিল। এগুলোর মাধ্যমে তারা প্রতিবেশী সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করত এবং শত্রুদের পরাজিত করত।

এই ভাসমান সাম্রাজ্যের নির্মাতা ছিলেন এক বিস্ময়কর মানুষ—যার উচ্চতা ছিল প্রায় সাত ফিট। তিনি শৈশবে অপহৃত হয়ে ইউনাক (পুরুষত্বহীন) বানানো হলেও ইতিহাসে তার নাম লেখা আছে সোনার অক্ষরে। তিনি হলেন ঝেং হে।


শিশুকাল থেকে সম্রাটের দাস

1300 শতাব্দীর শেষের দিকে, চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের ইউনান প্রদেশে জন্ম নেয় ছোট্ট এক বালক। তার বাবা ছিলেন মঙ্গোল শাসকদের অধীনস্থ কর্মচারী। কিন্তু মিং সাম্রাজ্য যখন মঙ্গোলদের হারায়, তখন শুরু হয় দমন-পীড়ন। সেই আক্রমণে বালক বাবাকে হারায়।

পরবর্তীতে মিং জেনারেলের হাতে বন্দী হয়ে তাকে বানানো হয় ইউনাক। কিন্তু এই নিষ্ঠুর ঘটনার মাধ্যমেই খুলে যায় ক্ষমতার দরজা। ধীরে ধীরে সে সম্রাটের বিশ্বস্ত দাসে পরিণত হয়।



ঝেং হে-র উত্থান

বালকের নতুন নাম রাখা হয় মাহি। টেস্টোস্টেরনের অভাবে তার শরীর অস্বাভাবিকভাবে লম্বা হয় এবং সে সাত ফিট উচ্চতার এক দৈত্যাকৃতির মানুষে পরিণত হয়।

রাজপুত্র ইয়ংলে (জুলি) ধীরে ধীরে মাহিকে নিজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে গড়ে তোলেন। সৈনিক থেকে শুরু করে অফিসার—ক্রমশ পদোন্নতি পেতে থাকে সে। পরে ইয়ংলে সম্রাট সিংহাসনে বসার পর মাহিকে নতুন নাম দেন ঝেং হে এবং তার হাতে দেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবহরের দায়িত্ব।


ভাসমান সাম্রাজ্য: ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নৌবহর

ঝেং হে-র নেতৃত্বে তৈরি হয় ২৭,০০০ সৈন্য, নাবিক, চিকিৎসক, অনুবাদক ও কর্মকর্তার বিশাল বহর। তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের জাহাজ—

  • পরিবহন জাহাজ

  • যুদ্ধজাহাজ

  • ঘোড়ার জাহাজ

  • কিংবদন্তি ধনজাহাজ

একেকটি ধনজাহাজ ছিল দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪০০ ফুট, প্রস্থে ১৮০ ফুট, চারতলা ডেক আর নয়টি মাস্তুল। এগুলো ছিল কামান, খাবারের ভাণ্ডার, সোনা-রূপা, সিল্ক ও চীনামাটির দ্রব্যে পূর্ণ।


ঝেং হে-র সমুদ্রযাত্রা

  • ১৪০৫ সালে প্রথম অভিযান শুরু হয়।

  • ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সে পৌঁছে যায় মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কায়।

  • জলদস্যু দমন করে বানায় নিরাপদ বাণিজ্য পথ।

  • শ্রীলঙ্কার রাজাকে বন্দী করে সম্রাটের কাছে নিয়ে যায়।

  • পরে সে আরব উপকূল ও আফ্রিকার কেনিয়াতেও পৌঁছে যায়।

ঝেং হে ফিরিয়ে আনে বিস্ময়কর উপহার—আফ্রিকার জিরাফ, ভারতীয় মসলা ও আরবের ঘোড়া। বিনিময়ে সবাই চীনের ঐশ্বর্য ও শক্তির কাছে মাথা নত করে।


পতন ও বিতর্ক

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কনফুসিয়ান পণ্ডিতরা সমুদ্রযাত্রাকে অপচয় হিসেবে সমালোচনা করতে শুরু করে। বজ্রপাতের মতো ঘটনাকে তারা দেবতার অভিশাপ হিসেবে প্রচার করে। অবশেষে নতুন সম্রাট সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ করে এবং বিশাল বহর ভেঙে ফেলা হয়।

আজও ইতিহাসবিদরা বিতর্ক করেন—

  • সত্যিই কি এসব জাহাজ এত বড় ছিল?

  • নাকি ইতিহাসে অতিরঞ্জন করা হয়েছে?

কেউ বলেন কাঠ ও প্রযুক্তি দিয়ে এত বড় জাহাজ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আবার কেউ নানজিং শিপইয়ার্ডে পাওয়া বিশাল রাডার প্রমাণ হিসেবে দেখান।



উপসংহার

যা-ই হোক না কেন, ঝেং হে-র নাম ইতিহাসে অমর। দাস থেকে উঠে আসা এই মহানায়ক একসময় সমুদ্র শাসন করেছিল। প্রশ্নটা থেকে যায়—এসব জাহাজ সত্যিই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ছিল নাকি মানুষের কল্পনায় তৈরি এক কিংবদন্তি?




Post a Comment

0 Comments