চাঁদের রহস্যময় গহবর: মানবজাতির ভবিষ্যতের আশ্রয়?
জাপানি স্যাটেলাইটের আবিষ্কার
15 বছর আগে একটা জাপানি স্যাটেলাইট চাঁদের কক্ষপথ থেকে কিছু অস্বাভাবিক দৃশ্য ধারণ করে। অসংখ্য উল্কাপাতের গর্তের মাঝে দেখা যায় এক আশ্চর্য অন্ধকার গহব্বর যা সোজা চাঁদের অভ্যন্তরে নেমে গেছে। এটা কোন উল্কাপাতের গর্ত না বরং এক রহস্যময় গভীর গর্ত। পরবর্তী পর্যবেক্ষণে জানা যায় এমন আরো 200রও বেশি গহব্বর চাঁদের পিঠে ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটা যেন চাঁদের ভেতরের গোপন জগতের প্রবেশদ্বার। এমন আবিষ্কারে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমূল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ মনে করা হচ্ছে চাঁদের প্রাচীন অতীত এবং মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হয়তো লুকিয়ে আছে এই গহবরগুলোর অন্ধকারে। কিন্তু আসলে কি এই রহস্যময় ছিদ্রগুলো? কেন এগুলো পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানীদের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে? আর চীন কেনইবা এই গহব্বর গুলোর মধ্যে প্রবেশ করার জন্য আমেরিকার সাথে লড়াইয়ে নেমেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক মানবজাতির জন্য কিঅপেক্ষা করছে চাঁদের এই ভয়ঙ্কর রহস্যময় গহবর গুলোতে।
চীনের মহাকাশ দৌড়
চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহাকাশ প্রতিযোগিতায় দ্রুত শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। তাদের নিজস্ব স্পেস স্টেশন তিয়াঙ্গং চালু হয়েছে। সফল চাং ইচন্দ্রাভিজান চলছে এবং এখন তারা সরাসরি আমেরিকার সাথে এক নতুন চাঁদ বিজয়ের দৌড়ে নেমেছে। 2023 সালের মে মাসে চীনের মানব মহাকাশ সংস্থা ঘোষণা করেছে যে 2030 সালের মধ্যেই তারা চাঁদে মানুষকে অবতরণ করাবে এবং সেখানে স্থায়ী ঘাটিও গড়বে। সম্ভাব্য অবতরণস্থল হিসেবে যেসব জায়গার কথা ভাবা হচ্ছে তার মধ্যে চাঁদের সেই অদ্ভুত গহব্বরগুলোর অঞ্চলগুলো রয়েছে চীনের তালিকায়।
গহব্বরের প্রকৃত রহস্য: লাভা টিউব
কিন্তু কি এমন বিশেষত্ব আছে এই রহস্যময় গহব্বর গুলোর মধ্যে যে চীন সেখানে মানুষ পাঠাতে চাইছে এবং সেখানে ঘাটিও গড়তে চাইছে। দূর থেকে দেখলে গহব্বরগুলো সাধারণ উল্কাপাতের ক্র্যাটার বলেই মনে হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের ধারণা এগুলো আসলে চাঁদের ভেতর দিয়ে ছুটে যাওয়া প্রাচীন লাভা সুরঙ্গের ধষে পড়া ছাদ। কোটি কোটি বছর আগে চাঁদে আগ্নিয়গিরির অগ্নুৎপাত হতো। গলিত লাভা নদীর মত বয়ে গিয়ে পৃষ্ঠের নিচে দীর্ঘ সুরঙ্গ তৈরি করত। পরে লাভা ঠান্ডা হয়ে জমে যায় এবং ভেতরে ফাঁকা চ্যানেল থেকে যায় যাকে বলা হয় লাভা টিউব। পৃথিবীতে আজও হাওয়াইয়ের মত স্থানে এমন লাভা টিউব দেখা যায়। যেমন কাজুমুরা গুহা প্রায় 65 কিলোমিটার দীর্ঘ। কিন্তু চাঁদে কম মধ্যাকর্ষণের কারণে এগুলো আরো দীর্ঘ। কোনটা তো কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া। সময়ের সাথে সাথে কিছু সুরঙ্গের ছাদ ভেঙে পড়ায় চাঁদের পিঠে এই গভীর গর্তগুলো তৈরি হয়েছে। আর বাকি সুরঙ্গ এখনো নিচে অক্ষত অবস্থায় লুকিয়ে আছে। অর্থাৎ চাঁদের এই ধরনের প্রতিটা গহব্বর এক একটা বিশেষ প্রবেশপথ যা আমাদেরকে চাঁদের অভ্যন্তরে এক বিশাল বিলিয়ন বছরের পুরনো গুহাবিশ্বে নিয়ে যেতে পারে।
চাঁদে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ
তবে চাঁদে দীর্ঘ সময় টিকে থাকা মানুষের পক্ষে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ চাঁদে কোন বায়ুমন্ডল নেই। ফলে মহাজাগতিক রশ্শি এবং সূর্যের প্রাণঘাতী বিকিরণ সরাসরি চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে। সেই সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উল্কাপিণ্ড সরাসরি চাঁদের মাটিতে আঘাত হানে। কেননা এগুলো ঠেকানোর মতো চাঁদের কোন বায়ুমন্ডলী নেই। এমনকি চাঁদের দিনে তাপমাত্রা প্রায় 100 ডিগ্রি সেলসিয়াস এরও বেশি এবং রাতে প্রায় মাইনাস 150 ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই চরম তাপমাত্রা যন্ত্রপাতি এবং মানুষের জন্য মারাত্মক। কিন্তু যদি এসব মারাত্মক বিপদ থেকে লুকানোর একটুখানি নিরাপদ ঠাই পাওয়া যায়। হ্যাঁ চাঁদে সেই বিশাল লাভাটিউব বা বিশাল গুহাগুলোই হতে পারে সেই আশ্রয়। পাথরের মোটা দেয়াল মহাজাগতিক বিকিরণ আর উল্কাপিন্ডের আঘাত থেকে সুরক্ষা দিবে এবং গুহার ভেতরের তাপমাত্রাও বাইরের মত প্রচন্ড ওঠানামা না করে সহনীয় পর্যায়ে স্থির থাকবে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে এই গহব্বরের অভ্যন্তরে দিনের বেলাতে তাপমাত্রা প্রায় 17 ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। অথচ তখন বাইরে সূর্যের তাপে অথবা অন্ধকারে 100 থেকে মাইনাস 150 ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করে। এসব গুহার ভেতরে ঘাটি বানাতে পারলে চাঁদের নতুন করে নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ার ঝামেলা অনেকটাই কমে যাবে। অনেক সুরঙ্গ তো এত বিশাল যে ভেতরে এক একটা শহর গড়ে তোলা সম্ভব। তাই বলাই যায় এই প্রাকৃতিক গুহাগুলো ভবিষ্যতে চাঁদে স্থায়ী মানব কলনী স্থাপনের জন্য মজবুত ভিত হতে পারে।
প্রাকৃতিক শিল্ড ও পৃথিবীর মত পরিবেশ
শুধু বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়াই না আরো এক ধাপ এগিয়ে এই প্রাকৃতিক গুহাগুলো পুরোপুরি বসবাসের যোগ্য করে তোলা সম্ভব। যদি সুরঙ্গের মুখগুলো সিল করে ভিতরে পৃথিবীর মত বাতাস ভরে দেয়া যায় তখন পুল পাথরের ছাদ আমাদের জন্য প্রাকৃতিক শিল্ডের মত কাজ করবে। ভেতরে তৈরি হবে প্রায় পৃথিবীর মত পরিবেশ। কিন্তু মধ্যাকর্ষণ থাকবে ছয় ভাগের এক ভাগ। কি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হবে ভাবুন তো? যদি একবার চাঁদের গুহার মধ্যে এগুলো গড়ে তোলা যায় তাহলে পৃথিবী থেকে ঘন ঘন রসদ পাঠানোর প্রয়োজনও কমে আসবে। স্থায়ীভাবে চাঁদে বসবাস করা তখন শুধু স্বপ্ন না অত্যন্ত বাস্তব এমনকি শাশ্রয়ী হয়ে উঠবে।
অভিযান ও প্রযুক্তি
তবে এসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগে প্রথম কাজ হলো এই গহব্বরগুলোতে অভিযান চালিয়ে গঠন এবং স্থায়িত্ব পরীক্ষা করতে হবে। কারণ না জেনে কোন নভচারীকে অজানা অন্ধকারে পাঠানো মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। ভেতরে কি আছে আর গুহার ছাদ বা মাটি কতটা শক্ত এসব আগে থেকেই জানা জরুরি। এই কারণে বিশ্বজুড়ে মহাকাশ সংস্থাগুলো এমন বিশেষ রোবট তৈরি করেছে যেগুলো গহব্বরের ভেতরে প্রবেশ করে সেখান থেকে ছবি তুলে মানচিত্র বানিয়ে পাঠাতে পারবে আমাদের পৃথিবীতে। যেমন নাসার রোভার সিস্টেম এসব গহব্বরের ধারে নিজেকে ল্যান্ড করয়ে আংশিকভাবে নিচে নেমে ক্যামেরা বা লেজারের সাহায্যে গুহার ভেতরের ছবি স্ক্যান করবে। আবার ছোট গোলাকার রোবট গড়িয়ে গড়িয়ে সুরঙ্গের ভেতরে ঢুকে থ্রিডি মানচিত্র তৈরি করবে। এমনকি হকিং রোবটেরও চিন্তাভাবনা চলছে যা চাঁদের কম মধ্যাকর্ষণের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে গর্তে নেমে পড়ে আবার বেরিয়েও আসতে পারবে খুব সহজে। [মিউজিক] পাশাপাশি এখানে থাকতে পারে মূল্যবান কিছু সম্পদও। কারণ চাঁদের মাটিতে হিলিয়াম থ্রি নামে এক বিরল আইসোটোপ পাওয়া যায় যা ভবিষ্যতে পারমাণবিক ফিউশন চুল্লির জ্বালানি হিসেবে প্রায় অফুরন্ত শক্তি সরবরাহ করতে পারবে। আবার সূর্যের আলো না পৌঁছানো গভীর গুহায় পানি বরফ আকারে জমে থাকতে পারে।
মহাকাশ অভিযানের মঞ্চ হিসেবে চাঁদ
তাই আমরা যদি চাঁদেই এই সকল রস সংগ্রহ এবং উৎপাদন করতে পারি তবে পৃথিবী থেকে সবকিছু বহন করারও আর দরকার পড়বে না। চাঁদই হয়ে উঠবে দুর্মহাকাশ অভিযানগুলোর একটা বিরাট উৎক্ষেপণ মঞ্চ। এখান থেকেই পানি, বাতাস, জ্বালানি নিয়ে আমরা মঙ্গল গ্রহসহ সৌরজগতের আরো দূরে হয়তো পাড়ি দিতে পারব।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
ভাবতেই অবাক লাগে হাজার বছর আগে যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষরা বাঁচার তাগিদে পৃথিবীর গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল, আজ আমরা হয়তো আবার সেই গুহার পথেই ফিরে যাচ্ছি। তবে এবার হয়তো পৃথিবীতে না চাঁদের বুকে। চাঁদের এই প্রাচীন লাভাগুহা গুলো মানবজাতির আগামী দিনের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে। আর তাই বলাই যায় ইতিহাস যেন আবারো ঘুরে ফিরে আসছে।


0 Comments