বিটু স্পিরিট: পরিচিতি ও রহস্য
এমন একটা যুদ্ধবিমান আছে যার নাম বি টু স্পিরিট বোম্বার প্লেন। যেটা বর্তমান পৃথিবীর সবথেকে ভয়ঙ্কর, রহস্যময় এবং অদৃশ্য ভুতুরে যুদ্ধবিমান। এই বিমান পুরো একটা ফুটবল মাঠের সমান হলেও পৃথিবীর কোন রাডারই একে শনাক্ত করতে পারে না। পুরো পৃথিবীর সব রাডারের চোখে এটা যেন ছোট্ট এক মাকরসা। হ্যাঁ, শত্রুর চোখে সে একদম অদৃশ্য। এর ডিজাইন এমন এক অভিনব পদ্ধতিতে করা হয়েছে যা রাডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে এটা বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলে। 2 বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি করা এটাই বিশ্বের সবথেকে ব্যয়বহুল যুদ্ধ বিমান। শুধু এতটুকুই না এটা রাডারের সাধারণ আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি এমন সব মিসাইল থেকে বাঁচতে পারে যেগুলো তার ইঞ্জিন থেকে বের হওয়া তাপ শনাক্ত করে আঘাত করতে পারে। ভাবুন এই বোম্বার প্লেন চাইলে পুরো বিশ্বের মানচিত্র একাই পরিবর্তন করে দিতে পারে। কি আছে এই যুদ্ধবিমানে? যেটা আমেরিকা পৃথিবীর আর কোন দেশের সাথে ভাগ করতে চায় না? কেন আমেরিকা তার সব অস্ত্র অন্য দেশে বিক্রি করলেও পুরো পৃথিবীতে রাজ করার এই মেইন হাতিয়ার অন্য দেশের কাছে বিক্রি করে না? কিভাবেই বা এই বোম্বার প্লেন একসাথে পুরো পৃথিবীতে বোমা ফেলতে পারে। কিন্তু তারপরেও কেন পুরো পৃথিবীর সব রাডার মিলেও এই প্লেনকে শনাক্ত করতে পারে না। তো চলুন জেনে নেয়া যাক আমেরিকাকে রাজার সিংহাসনে বসানো এই প্লেনের আদ্যপান্ত। 1960 সালের মে মাসে পাকিস্তানের পেশোয়ার এয়ারবেস থেকে উড়ে যায় আমেরিকার গোপন যুদ্ধবিমান লক হিট ইউ টু স্পাইপ্লেন। এটা ছিল এক অত্যন্ত গোপন এবং ঝুঁকিপূর্ণ মিশন। যার লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচর বৃত্তি করা। শীতল যুদ্ধের উত্তেজনা যখন তুঙ্গে আর আমেরিকার গর্ব ছিল এই ইউটো প্লেন যেটা 80000 ফুট উচ্চতা দিয়ে উড়তে পারে। যেখানে কোন শত্রু মিসাইল তাকে আঘাত করতে পারে না। তাদের ধারণা ছিল এত উঁচুতে কোন অস্ত্র তাকে ধ্বংস করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিশালী রাডার দ্রুত এই প্লেনের অবস্থান শনাক্ত করে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে তারা ফাইটার জেট এবং মিসাইল ছুড়ে আক্রমণ চালায়। কিন্তু এত উঁচুতে আক্রমণ করা ছিল বেশ কঠিন। অবশেষে সোভিয়েতদের এস75 ডিভিনা মিসাইল লক্ষ্য করে ফায়ার করে। যেটা এমন উচ্চতায় গিয়ে ইউ প্লেনকে একেবারে নিখুতভাবে আঘাত করে। প্লেনটা বিধ্বংস হয়ে সোভিয়েতদের এলাকায় আছড়ে পড়ে। শুরুতে আমেরিকা দাবি করে এটা নাসার আবহাওয়া গবেষণার একটা বিমান। কিন্তু সোভিয়েতরা পাইলট এবং বিমানটার গোপন সরঞ্জাম উদ্ধার করে বিশ্ববাসীর সামনে আনে। এতে আমেরিকার গোয়েন্দা গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যায় এবং বিশ্বমঞ্চে তাদেরকে এক বড় ধরনের অপমানের শিকার হতে হয়। এই ঘটনায় বদলে দেয় শীতল যুদ্ধের গেম প্ল্যান। রাশিয়া নিজেদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করে। আর আমেরিকা নতুন প্রযুক্তির বিমান তৈরি করার পথে এগিয়ে যায়। যে বিমান আর কখনোই রাডারে ধরা পড়বে না। শীতল যুদ্ধের সেই টানাপরণের সময় আমেরিকা বুঝতে পারে তাদের দরকার এমন এক যুদ্ধবিমান যা শত্রুর রাডারে কখনো ধরা পড়বে না। দ্রুত তাদের এলাকায় ঢুকে বোমা ফেলবে এবং অক্ষত অবস্থায় আবার ফিরে আসবে। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই 1978 সালে শুরু হয় অ্যাডভান্স টেকনোলজি বোম্বার প্রোগ্রাম যার লক্ষ্য ছিল এমন একটা বিমান তৈরি করা যা হবে অদৃশ্য এবং ভুতুরে। 1989 সালে প্রথমবার আকাশে ওড়ে এই বিমান। কিন্তু বিশ্বের সামনে প্রথম 1997 সালেই প্রকাশ করা হয় বিটু স্পিরিট বোম্বার। বিটু বোম্বারের সবচাইতে বড় শক্তিশালী হলো এর স্টেথ প্রযুক্তি। এর ডিজাইন এমন এক অভিনব পদ্ধতিতে করা হয়েছে যার কারণে রাডারের তরঙ্গ বিমানটার উপরে পড়লেও আর ফিরে আসে না। বরং সেগুলো অন্যদিকে ছিটকে যায়।
ফলে রাডার বিভ্রান্ত হয় এবং বিমানের অবস্থান সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে না। এই বিমানে ফিউজলেস বা টেলফিন নেই। আছে শুধুমাত্র বিশাল ডানা। সাধারণ বিমানগুলোর ভার্টিকাল টেলফিন রাডারে স্পষ্ট দেখা যায় এবং সেটাই তাদের অবস্থান প্রকাশ করে। কিন্তু বিটুতে এই টেলফিন বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এর বদলে জিগজ্যাগ ডিজাইন ব্যবহার করা হয়েছে। যা রাডারের সিগনালকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। বিমানটার গায়েও ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষ কার্বন গ্রাফাইট আবরণ। যা রাডারের তরঙ্গকে শোষণ করে ফেলে এবং বিমানের উপস্থিতি গোপন রাখে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর ইলেকট্রনিক কাউন্টার মেজার সিস্টেম। যা শত্রু রাডারের তরঙ্গ ধরেই তা পরিবর্তন করে ফেলে। ভুল অবস্থান দেখায় ফলে রাডার সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে না। কখনো কখনো শত্রু রাডার একসাথে অনেকগুলো জায়গায় বি টু বোম্বার প্লেনকে দেখতে পায়। অথচ বিমানটা এক জায়গাতেই থাকে। এইসব কৌশল মিলিয়ে বিটু স্পিরিট বোম্বার হয়ে ওঠে এক নিখুত অদৃশ্য যোদ্ধা। বিটুক স্পিরিট বোম্বারের গোপনীয়তার আরেক প্রধান রহস্য স্বয়ং এর ইঞ্জিন। সাধারণ যেকোনো যুদ্ধবিমান থেকে যখন গরম ধোঁয়া বের হয় তখন শত্রুর ইনফ্রারেড সেন্সর তা খুব সহজেই শনাক্ত করতে পারে। কিন্তু বিটোর ইঞ্জিন এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে গরম বাতাস বাইরে বের হওয়ার আগেই সেটা ঠান্ডা হওয়ার সঙ্গে মিশে যায়। ফলে শত্রুর ইনফ্রারেড সেন্সর সেই তাপকে আর শনাক্ত করতে পারে না। এর ফলে বিটু শুধু রাডার না বরং হিট সিকিং মিসাইল থেকেও নিরাপদ থাকে। সেই সাথে বিটু বোম্বার প্লেন সাধারণত 15,000 ফুট বা প্রায় 500 ফুট উচ্চতায় পূর্ণ জ্বালানি নিয়ে প্রায় 11,000 কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই বিমান দীর্ঘ দূরত্বের মিশনেও একটুও শত্রুর রাডারে ধরা পড়ে না। হ্যাঁ। এই বিমান একাধিক গোপন এবং রহস্যময় মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। যেখানে তার স্টেলথ ক্ষমতা এবং নির্ভুল বোমাবর্ষণ পুরো যুদ্ধের ফলাফলই বদলে দিয়েছে। যেমন 1990 এর দশকে আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় মিজরি এয়ারফোর্স বেস থেকে উড়ে বিটু প্রায় 9500 কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নির্ভুলভাবে বোমা বর্ষণ করেছিল। আর একটাও রাডারে না ধরা পড়ে ফিরে এসেছিল। এর মধ্যে মাঝ আকাশে মাত্র একবার জ্বালানি সরবরাহ রিলোড করতে হয়েছিল। পুরো এই অভিযান প্রায় 45 ঘন্টা স্থায়ী হয়েছিল। তারপর 1999 সালে অপারেশন আলায়েড ফোর্সের সময় সারবিয়াই বিটুর কার্যক্রম ছিল নজিরবিহীন। 2003 সালে অপারেশন ইরাক ফ্রিডমে এবং 2011 সালে অপারেশন ওডিসি ডনে লিবিয়ায় বিটু তার এই মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রদর্শন করেছিল বিশ্ববাসীর সামনে। এই মিশনগুলোতে বিটু তার উচ্চ প্রযুক্তি এবং দীর্ঘদূরত্ব ভ্রমণ এবং স্টেলথ ক্ষমতা পুরো পৃথিবীর যুদ্ধকৌশলকে পাল্টে দিয়েছিল। আর এইসব মিশনের মাধ্যমে বিটু স্পিরিট বোম্বার প্রমাণ করেছে কেন এটা বিশ্বের সেরা স্টেলথ বোম্বার হিসেবে পরিচিত। বি টু স্পিরিট বোম্বার শুধুমাত্র স্টেলথ প্রযুক্তিতেই না বরং এটা তার অস্ত্রবহনের ক্ষমতাতেও অসাধারণ। এই বিমান একসঙ্গে প্রায় 18,000 কেজি বা 15 টা গাড়ির সমান বিস্ফোরক বহন করতে পারে। বিমানটার ভেতরে অত্যাধুনিক জিপিএস গাইডেড বোম্পেজ ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে সর্বোচ্চ 80 টা বোম্ব বা ক্ষেপণাস্ত্র একসাথে রাখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ষোল টা বিল্টি থ্রি নিউক্লিয়ার বোম্ব এবং ষোল টা এজিএম ওয়ান ফাইনা জেসম নামের স্টেথ ক্রুজ মিসাইল। এই বি টু বোম্বারের রেঞ্জ এতটাই বিস্তৃত যে এটা আমেরিকা থেকে রাশিয়ার মধ্যে কোন স্থানে না গিয়েই আবার ফিরে আসতে পারে। মাঝ আকাশেই প্রয়োজনীয় সময়ে রিফয়েলিং করা যায় যা বিমানের পরিসর আরো বাড়িয়ে দেয়। এই অস্ত্রবহন ক্ষমতা এবং স্টেথ প্রযুক্তির সমন্বয় একসাথে বি টু স্পিরিট বোম্বারকে পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী এবং ভয়ঙ্কর যুদ্ধবিমান গুলোর একটা করে তুলেছে। বিটু স্পিরিট বোম্বার শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত দিক দিয়েই না, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনাতেও অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। এই বিমান প্রতি ঘন্টায় প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ ডলারের জ্বালানি খরচ করে। যা একটা সাধারণ বাণিজ্যিক জেটের তুলনায় বহুগুণ বেশি। এই কারণেই বিটু বোম্বার প্লেন পরিচালনা করাও একটা বিরাট খরচের ব্যাপার। এমনকি মিশন শেষে বিমানটাকে পুরোপুরি পরিষ্কার করতে হয় যেন এর বিশেষ গোপন স্টেলথ কোটিং অক্ষুন্ন থাকে। বিমানটার শরীরের প্রতিটা অংশ সাবধানে পরীক্ষা করা হয়। যাতে কোন জায়গায় ক্ষত বা ডেন্ট না থেকে যায়। কারণ এক টুকরো ক্ষত বা ডেন্ট হলেও বিমানটা সহজেই রাডারে ধরা পড়তে পারে। এই রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া এক ধরনের শিল্পকলার মতো। যেখানে প্রতিটা অংশ নিখুতভাবে রক্ষা করা হয়। এ কারণেই আজ পর্যন্ত মাত্র 21 টা বিটু স্পিরিট বোম্বার প্লেন তৈরি করা হয়েছে এবং সেই সবগুলো আমেরিকার হাতেই আছে। তাদের এই বিমানের প্রযুক্তি বিক্রি বা ভাগাভাগি করার কোন পরিকল্পনা তাদের নেই। কারণ এটা তাদের একটা গোপন অস্ত্র এবং পুরো বিশ্বে আধিপত্য বজায় রাখার অন্যতম একটা হাতিয়ার।

0 Comments