মেসিভ চাইনিজ হ্যাকারদের নিঃশব্দ যুদ্ধ: কাকে হারিয়ে দিলো বিশ্ব?

 মেসিভ চাইনিজ হ্যাকারদের নিঃশব্দ যুদ্ধ: কাকে হারিয়ে দিলো বিশ্ব?




ম্যাসিভ চাইনিজ। এক নিঃশব্দ যুদ্ধ যেখানে বোমা ফাটে না ট্যাঙ্কও নামে না। শব্দ শোনা যায় কেবল কিবোর্ডের। 2017 সালের পর হঠাৎ করেই বিশ্বজুড়ে নেমে আসে এক অদ্ভুত নীরবতা। যে চীনা হ্যাকারদের নাম শুনলেই প্রতিযোগীরা কাঁপতো। যারা একের পর এক আন্তর্জাতিক হ্যাকিং প্রতিযোগিতা জিতে আসতো তারা হঠাৎ করেই উধাও। আলো জ্বলছে মঞ্চ তৈরি। কিন্তু সেই চিরচেনা মুখগুলো আর নেই। প্রশ্ন শুধু একটাই তারা কোথায়? বিশ্ববিখ্যাত চীনা হ্যাকাররা হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেল? চলুন একটু পেছনে ফেরা যাক। ভ্যানকুভার মার্চ 2017 সাইবার জগতের ওয়ার্ল্ড কাপ

বলা হয় এমন এক প্রতিযোগিতা। পিডবউ এনটওডব এন। এখানে নিয়ম খুবই সোজা। Google কম মাইক্রসফট উন্ডোজ আইফোন এর মত জনপ্রিয় সফটওয়্যার বা ডিভাইসের নতুন এবং পুরাতন দুর্বলতা বা বাঘ খুঁজে বের করতে হয়। কোম্পানিকে জানাতে হয় যাতে তারা দ্রুত আপডেট দিয়ে সেগুলো সমাধান করে ফেলতে পারে। হ্যাকাররা পায় বড় অংকের পুরস্কার। বহু বছর ধরেই চীনা হ্যাকাররা এই প্রতিযোগিতার তারকা। যে ইভেন্টেই নামে পুরস্কার তাদের হাতেই ওঠে। কিন্তু 2017র পর এই ছবিটা বদলে যেতে শুরু করে। একেকটা আন্তর্জাতিক ইভেন্ট শেষ হয় আর দেখা যায় চিরচেনা চীনের দলগুলো আর প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে না। আমেরিকা থেকে ইউরোপ সবখানেই এই একই অস্বস্তি ছড়িয়ে যায়। কি হচ্ছে চীনের হ্যাকারদের সাথে? কেন তারা উধাও? গোটা পৃথিবী জুড়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। এই নীরব সময়ে চীনের সবচাইতে বড় সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি কুইহো 360টি এর সিইও ঝো হংই একটা বক্তব্য দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন। তিনি বলেন, বিদেশে গিয়ে স্কিল দেখিয়ে লাভটা কি? ওই জেতাটা নাকি খেয়ালই জয় অর্থাৎ শুধু লোক দেখানো। তার মতে পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানির যে সকল দুর্বলতা গুলোকে ধরা হয় তার দাম আসলে কয়েক লাখ টাকা নয়। বরং কয়েক বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হওয়া উচিত। এর কিছুদিন পরেই দেখা যায় চীনা হ্যাকাররা বিদেশী প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এটা হ্যাকারদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত না বরং সরকারের নিষেধাজ্ঞা আছে। অর্থাৎ বাইরের মঞ্চের দরজা বন্ধ হয়ে যায় চীনা হ্যাকারদের জন্য আর খুলে যায় ভেতরের নতুন এক মঞ্চ। সেই নতুন মঞ্চের নাম টায়ান ফুকাপ। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বিকল্প হিসেবে চীন দেশেই সেটা আয়োজন করা হয়। আর প্রাইজ মানে মিলিয়নেরও বেশি। মানে সবচাইতে সেরা ট্যালেন্টকে খুঁজে বের করে আনার এক প্রতিযোগিতা। এই লঞ্চের খবর বেরোতেই নানা দেশের কপালে ভাঁজ পড়ে যায়। ইশারা স্পষ্ট চীন হ্যাকিংকে ব্যবহার করে সাইবার যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চায়। 2018 সালের নভেম্বরে চেন্দু শহরে হয় প্রথম টায় ইনফো কাপ। ঠিক সেই মঞ্চেই উঠে আসে এক ঝড়ের নাম। কুইহো 360 এর গবেষক কি ঝুনঝাও দেখান কিভাবে শুধু একটা বিশেষ ওয়েবপেজ খোলা মাত্রই আইফোন কে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায়। উইন্ডো খুলতে হয় সাফারি ব্রাউজার দিয়ে। তারপরে অপারেটিং সিসমের গভীরে লুকানো ফাঁক দিয়ে পুরো ডিভাইসকেই গ্রাস করা যায়। ব্যবহারকারী বুঝতেই পারে না। কোন সতর্ক বার্তা ওঠে না তবুও মাইক্রোফোন, ক্যামেরা, লোকেশন, মেসেজ সবকিছু এক অদৃশ্য হাতে চলে যায়। এই এক্সপ্লয়েটের নাম দেওয়া হয় কায়স। কারণ এটার প্রভাবেই বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। এমন এক্সপ্লয়েট কালো বাজারে গেলে মিলিয়ন ডলার পাওয়া যায়। অপরাধচক্র বা কোন রাষ্ট্র চাইলে হাজার হাজার মানুষের ফোনে এই নজরদারি বসিয়ে দিতে পারে কায়স হ্যাকিং সিস্টেম কিনে। এরপরে কি হয়? 2019 সালের জানুয়ারিতে appল নীরবে আপডেট দিয়ে সেই ফাঁক বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আসল চমক আসে ওই বছরের আগস্টে। Google একটা রিসার্চে প্রকাশ করে দীর্ঘ সময় ধরে আইফোনে এ বড় মাপের হ্যাকিং ক্যাম্পেইন চলছে। পাঁচটা আলাদা হ্যাকিং গ্রুপকে শনাক্ত করা হয়। তার মধ্যে একটা চেইন টায়নফো কাপে দেখানো কায়স এর সাথে মিলে যায়। ধাপে ধাপে কাঠামোয় কাজের ধরনের সবকিছুতেই। অর্থাৎ মঞ্চে যে ডেমোটা দেখা যায় বাস্তব জগতে সেটাই ব্যবহার করে নজরদারি চালানো হয়। পরে মিডিয়া অনুসন্ধান, Google এর টেকনিক্যাল নোট আর অ্যাপেল এর সময় রেখা মিলিয়ে বোঝা যায় প্রধান টার্গেট ছিল শিংচজিং এর উইঘুর মুসলিমরা। পাশাপাশি সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং সরকারের সমালোচকও তাদের নিশানা থেকে বাদ যায় না। এখানেই এই গল্পের শেষ না। 2024 সালের ফেব্রুয়ারিতে
গিটহাবে ফাঁস হয় আইসুন নামের একটা চীনা আইটি সিকিউরিটি ফার্মের ডেটা। ইমেইল, চ্যাটলগ এমনকি স্পাইওয়ার ডেভেলপমেন্টের নতিও সেখানে থাকে। ফাঁস হওয়া কাগজপত্রে দেখা যায় তারা সাইবার স্পায়িং টুল বানায় এবং সেগুলো সরাসরি সরকারি সংস্থা এবং চাইনিজ মিলিটারিদেরকে দিয়ে দেয়া হয়। এমনকি চুক্তিপত্রে প্রতিটা হ্যাক মেইল ইনবক্সের জন্য নির্দিষ্ট ফি এরও উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকি 2024 সালে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টে চীনা রাষ্ট্র সমর্থিত হ্যাকাররা অনুপ্রবেশ করে। সংবেদনশীল নথি চুরি করে। ওই বছরই অন্তত নয়টা মার্কিন টেলিকম নেটওয়ার্ক, এটিএমটি,ভেরাইজন, টা মোবাইল সহ অনেকগুলো কোম্পানি টার্গেট করা হয়। তার আগের বছর ভোল্ট টাইফুন নামে একটা পরিচিত চীনা গ্রুপ আমেরিকার এনার্জি এবং ওয়াটার ফিল্ট্রেশন সিস্টেমকে লক্ষ্য করে সাইবার অটাক চালায়। 2023 সালে গুয়ামের আশেপাশের সামরিক ঘাটির কাছে অস্বাভাবিক মালোয়ারও ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে জানা যায়, এই গ্রুপগুলো বহু বছর নীরবে ভেতরে এক্সেস নিয়ে রাখে। আর সময় এলেই আঘাত করে। মিসাইল নয় বরং মূল শক্তি কোড। বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দ নয় বরং ব্রিজের নিঃশব্দ স্রোত। এক ক্লিকে ব্যাংকের দরজায় গোলযোগ আরেক ক্লিকে এয়ারপোর্টের সিগনাল অচল আরেক
ক্লিকে বাজারে আতঙ্ক। বাইরে থেকে সবকিছুই যেন স্বাভাবিক মনে হয়। অথচ ভেতরে ডেটা রক্তখরণ চলতেই থাকে। সময়ের সবথেকে ভয়ঙ্কর যুদ্ধটা চলছে আপনার পকেটের ভেতরেই। আমরা ভাবি ফোনটা তো নিছক এক ডিভাইস। কিন্তু এর ভেতরেই আছে আমাদের কথা, ছবি, পরিচয়, বিশ্বাস সব। আর এটাই আজকের যুদ্ধক্ষেত্র। তাই কৌতুহলী থাকুন, সতর্ক এবং সচেতন থাকুন।

Post a Comment

0 Comments